Subscribe:

Tuesday, June 28, 2016

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার


পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার বা সোমপুর মহাবিহার বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন। ১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়।
পাহাড়পুরকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধবিহার বলা যেতে পারে। আয়তনে এর সাথে ভারতের নালন্দা মহাবিহারের তুলনা হতে পারে। এটি ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্মচর্চা কেন্দ্র ছিল। শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই শুধু নয়, চীন, তিব্বত, মায়ানমার (তদানীন্তন ব্রহ্মদেশ), মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মচর্চা ও ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন। খ্রিস্টীয় দশম শতকে বিহারের আচার্য ছিলে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান।

কেন্দ্রিয় মন্দিরের দৃশ্যঅবস্থান ও আয়তন

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার
কেন্দ্রিয় মন্দিরের দৃশ্য
অবস্থাননওগাঁ, বাংলাদেশ
স্থানাংক২৫.০৩১০৯৫° উত্তর ৮৮.৯৭৭২৮৪° পূর্ব
উচ্চতা (সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে)৮০ ফুট (২৪ মি)
নির্মিত৪র্থ শতাব্দী
নির্মিত হয়েছেধারাম পাল
স্থাপত্য শৈলীগুপ্তা, পাল

ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান
ধরণসাংস্কৃতিক
বিচারধারাi, ii, iv
মনোনীত হয়েছে১৯৮৫ (৯ম সেশন)

রাষ্ট্রীয় পার্টি বাংলাদেশ
Regionএশিয়া-প্যাসিফিক
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার
বাংলাদেশের নওগাঁয় পাহাড়পুর বিহার নওগাঁ, বাংলাদেশ পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের অবস্থান
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার বাংলাদেশ-এ অবস্থিত

 

পুন্ড্রবর্ধনের রাজধানী পুন্ড্রনগর (বর্তমান মহাস্থান) এবং অপর শহর কোটিবর্ষ (বর্তমান বানগড়)-এর মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত ছিল সোমপুর মহাবিহার। এর ধ্বংসাবশেষটি বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহীর অন্তর্গত নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত। অপরদিকে জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে এর দূরত্ব পশ্চিমদিকে মাত্র ৫ কিলোমিটার। এর ভৌগোলিক অবস্থান ২৫°০´ উত্তর থেকে ২৫°১৫´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮°৫০´ পূর্ব থেকে ৮৯°১০´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত। গ্রামের মধ্যে প্রায় ০.১০ বর্গ কিলোমিটার (১০ হেক্টর) অঞ্চল জুড়ে এই পুরাকীর্তিটি অবস্থিত। প্রত্নতাত্ত্বিক এই নিদর্শনটির ভূমি পরিকল্পনা চতুর্ভূজ আকৃতির।[১] এটি বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের প্লাবন সমভূমিতে অবস্থিত, প্লাইস্টোসীন যুগের বরেন্দ্র নামক অনুচ্চ এলাকার অন্তর্ভুক্ত। মাটিতে লৌহজাত পদার্থের উপস্থিতির কারণে মাটি লালচে। অবশ্য বর্তমানে এ মাটি অধিকাংশ স্থানে পললের নিচে ঢাকা পড়েছে। পার্শ্ববর্তী সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০.৩০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত পাহাড়সদৃশ স্থাপনা হিসেবে এটি টিকে রয়েছে। স্থানীয় লোকজন একে গোপাল চিতার পাহাড় আখ্যায়িত করত; সেই থেকেই এর নাম হয়েছে পাহাড়পুর, যদিও এর প্রকৃত নাম সোমপুর বিহার।

আবিষ্কারের প্রেক্ষাপট

সোমপুর মহাবিহার, বাংলাদেশ।
সোমপুর মহাবিহারের একাংশের ছবি।
সোমপুর মহাবিহার প্রাঙ্গনের কাঠামো।
ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমনের পর তাঁরা সকল স্থানে জরিপ কাজ চালানো শুরু করেন। পূর্ব ভারতে জরিপ কাজ পরিচালনা করেন বুকানন হ্যামিল্টন; যিনি ১৮০৭ থেকে ১৮১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে পাহাড়পুর পরিদর্শন করেন। এটিই ছিল পাহাড়পুরে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক পরিদর্শন। এরপর এই প্রত্নস্থল পরিদর্শনে আসেন ওয়েস্টম্যাকট। এঁরা দেশে ফিরে তাঁদের অভিজ্ঞতা সম্বলিত বিবরণ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এরই সূত্র ধরে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই ঐতিহাসিক স্থানটি পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনের পর এই জমিটি ব্যাপক হারে খনন করার প্রতি তিনি আগ্রহ দেখান। কিন্তু জমির মালিক বলিহারের তদানীন্তন জমিদার তাঁকে এই কাজে বাধা দেন। তাই তিনি বিহার এলাকার সামান্য অংশে এবং পুরাকীর্তির কেন্দ্রীয় ঢিবির শীর্ষভাগের সামান্য অংশে খনন কাজ চালিয়েই অব্যাহতি দেন। এই খননকার্যের সময় কেন্দ্রীয় ঢিবির অংশে চারপাশে উদ্‌গত অংশবিশিষ্ট একটি বর্গাকার ইমারত আবিষ্কার করেন যার দৈর্ঘ্য ছিল ২২ ফুট। অবশেষে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের প্রত্নতাত্ত্বিক আইনের আওতায় এই স্থান ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসাবে ঘোষিত হয়।

ইতিহাস ও পটভূমি

৭ম শতাব্দীর মাঝামাঝিতে হিউয়েন ৎসাং পুন্ড্রবর্ধনে আসেন ও তার বিস্তারিত বিবরণে সোমপুরের বিহার ও মন্দিরের কোন উল্লেখ নেই। গোপালের পুত্র ধর্মপাল (৭৮১ - ৮২২ খ্রি) সিংহাসনে আরোহণ করে দীর্ঘকাল রাজত্ব করেন ও রাজ্যকে বাংলা বিহার ছাড়িয়ে পাকিস্তানের উত্তর - পশ্চিম সীমান্তের গান্ধার পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। সম্রাট ধর্মপাল অনেক নিষ্ঠাবান বৌদ্ধ ছিলেন ও তিনিই বিক্রমশীলা ও সোমপুর বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। অন্য মতে, বিখ্যাত তিব্বতীয় ইতিহাস গ্রন্থ "পাগ সাম জোন ঝাং" এর লেখক অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ধর্মপালের পুত্র দেবপাল (৮১০-৮৫০)কর্তৃক সোমপুরে নির্মিত বিশাল বিহার ও সুউচ্চ মন্দিরের উল্লেখ করেছেন। সোমপুর বিহারের ভিক্ষুরা নালন্দা, বুদ্ধগয়া প্রভৃতি ভারতীয় বিভিন্ন বৌদ্ধ তীর্থস্থানে অর্থ ও ধন রত্ন দান করতেন বলে বিভিন্ন লিপিতে উল্লেখ করা আছে যা ১০ - ১১শ শতাব্দীতে সমৃদ্ধশীল অবস্থার ইঙ্গিত বহন করে। এছাড়া ৯ম শতাব্দী পর্যন্ত পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সোমপুর বিহার ছাড়াও অগ্রপুর (রাজশাহীর অগ্রাদিগুণ), উষ্মপুর, গোটপুর, এতপুর ও জগদ্দল ( রাজশাহীর জগদল) বিহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ৯ম শতাব্দীর শেষভাগে গুর্জর রাজ প্রথম ভোজ ও মহেন্দ্র পাল, পাল সাম্রাজ্যের বিশেষ ক্ষতিসাধন করেন। পরে ১০ম শতাব্দীর শেষভাগে পাল বংশীয় রাজা মহীপাল (৯৯৫ - ১০৪৩) সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন ও সোমপুর বিহার মেরামত করেন। কিন্তু মহীপাল ও তার পুত্র নয়াপালের মৃত্যুর পর আবার পাল বংশের পতন শুরু হয়। এই সুযোগে মধ্যভারতের চেদীরাজ কর্ণ, চোলরাজ রাজেন্দ্র ও দিব্বো নামের এক দেশীয় কৈবর্ত সামন্ত নরপতি পর পর বরেন্দ্রভূমি আক্রমণ করেন। নালন্দায় পাহাড়পুর মন্দির ও বিহার ধ্বংসের উল্লেখ সম্ভবত এ সময়ের আক্রমণের। ১১শ শতাব্দীতে পাল বংশীয় রামপাল হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। ১২শ শতাব্দীতে দাক্ষিণাত্যের কর্ণাট থেকে আগত সেন রাজারা বাংলা দখল করেন। তাদের নিকটে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা হারায় সোমপুর। এ সময় শেষবারের মত সোমপুরের পতন শুরু হয়। ১৩শ শতাব্দীর শুরুতে ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ - বিন - বখতিয়ার খিলজী বাংলায় আক্রমণ করে প্রায় উত্তরবঙ্গই দখল করেন। সম্ভবত এই মুসলমান শাসকদের মূর্তিবিরোধী মনোভাবের ফলেই বৌদ্ধদের এই বিহার ও মন্দির সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হয়ে যায়।

প্রত্নতাত্ত্বিক খনন

পাহাড়পুরের খননকার্যকে দুভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমতঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্বকালীন সময়ে মূলত বৃটিশ যুগে, এবং দ্বিতীয়ত স্বাধীনতা-উত্তর কালে আশির দশকে। ১৮৭৯ সালে কানিংহাম প্রথম উদ্যোগটি নেন। কিন্তু বলিহারের জমিদারের বিরোধিতায় কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় ঢিবির শীর্ষভাগ খনন করে তাঁকে থেমে যেতে হয়। এ খননে চারপাশে উদগত অংশযুক্ত প্রায় ৭মি উঁচু একটি কক্ষ আবিষ্কৃত হয়। এর দীর্ঘদিন পর ১৯২৩ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বরেন্দ্র গবেষণা পরিষদ ও ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের যৌথ প্রচেষ্টায় এবং দিঘাপতিয়ার জমিদার পরিবারের সদস্য শরৎ কুমার রায়ের অর্থানুকূল্যে পুনরায় খননকাজ শুরু হয়। এ বছর ঐতিহাসিক ডি.আর.ভান্ডারকরের নেতৃত্বে প্রত্নস্থলটির দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে খনন পরিচালিত হলে উত্তর-দক্ষিণে বিন্যস্ত একসারি কক্ষ এবং চত্বরের অংশবিশেষ পাওয়া যায়। রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় ১৯২৫-২৬ সালে খনন করে কেন্দ্রীয় ঢিবির উত্তরে প্রধান সিঁড়ি, পোড়ামাটির ফলকচিত্র শোভিত দেয়াল ও প্রদক্ষিণ পথসহ উত্তর দিকের মন্ডপ বা হল ঘর আবিষ্কার করেন। ফলে প্রথমবারের মত এ বিহারের ভূমিপরিকল্পনা ও দেয়ালচিত্রণ সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। ১৯৩০-৩১ এবং ১৯৩১-৩২ সালে জি.সি.চন্দ্র বিহারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ ও সংলগ্ন চত্বর খনন করেন। ১৯৩৩-৩৪ সালে কাশিনাথ দীক্ষিতের তত্ত্বাবধানে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ পুনরায় খনন করে। এতে বিহার ও মন্দিরের অবশিষ্ট অংশ এবং সত্যপীরের ভিটায় একগুচ্ছ স্তূপসহ একটি তারা মন্দিরের ধ্বংশাবশেষ পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রফিক মোঘল পূর্ব বাহুর কয়েকটি কক্ষে গভীর উৎখনন পরিচালনা করেন।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ১৯৮১-৮৩ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ 'নতুন তথ্যের অনুসন্ধান এবং ইতোপূর্বে দীক্ষিতের আবিষ্কৃত কক্ষসমূহের প্রাপ্ত নিদর্শনাবলী সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া'র উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ের খনন কাজ শুরু করে। ১৯৮৭-৮৯ সালে পুনরায় খনন পরিচালিত হয় বিহার অঙ্গন থেকে অপ্রয়োজনীয় জঞ্জাল ও পূর্ববর্তী খননের স্তূপীকৃত মাটি অপসারণ করে সুশৃঙ্খল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যেন বিহারে বিদ্যমান জলাবদ্ধতা দূরীভূত হয় এবং লবণাক্ততা হ্রাস পায়।

স্থাবর স্থাপত্য নিদর্শনসমূহ

বিহার

বৌদ্ধ বিহারটির ভূমি-পরিকল্পনা চতুষ্কোনাকার। উত্তর ও দক্ষিণ বাহুদ্বয় প্রতিটি ২৭৩.৭ মি এবং পূর্ব ও পশ্চিম বাহুদ্বয় ২৭৪.১৫ মি। এর চারদিক চওড়া সীমানা দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। সীমানা দেয়াল বরাবর অভ্যন্তর ভাগে সারিবদ্ধ ছোট ছোট কক্ষ ছিল। উত্তর দিকের বাহুতে ৪৫টি এবং অন্য তিন দিকের বাহুতে রয়েছে ৪৪টি করে কক্ষ। এই কক্ষগুলোর তিনটি মেঝে আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রতিটি মেঝে বিছানো ইঁটের ওপর পুরু সুরকী দিয়ে অত্যন্ত মজবুত ভাবে তৈরি করা হয়েছিলো। সর্বশেষ যুগে ৯২টি কক্ষে মেঝের ওপর বিভিন্ন আকারের বেদী নির্মাণ করা হয়। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, প্রথম যুগে সবগুলো কক্ষই ভিক্ষুদের আবাসকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও পরবর্তীকালে কিছু কক্ষ প্রার্থনাকক্ষে রুপান্তর করা হয়েছিলো।
কক্ষগুলোর প্রতিটিতে দরজা আছে। এই দরজাগুলো ভেতরের দিকে প্রশস্ত কিন্তু বাইরের দিকে সরু হয়ে গেছে। কোন কোন কক্ষে কুলুঙ্গি পাওয়া যায়। কুলুঙ্গি সম্বলিত কক্ষগুলোর মেঝেতে দৈনন্দিন ব্যবহারযোগ্য বেশ কিছু দ্রব্যাদি পাওয়া যায়। ভেতরের দিকে কক্ষগুলোর দৈর্ঘ্য ৪.২৬ মি এবং প্রস্থ ৪.১১ মি। কক্ষের পেছনের দিকের দেয়াল অর্থাৎ সীমানা দেয়াল ৪.৮৭মি এবং সামনের দেয়াল ২.৪৪মি চওড়া। কক্ষগুলোর সামনে ২.৫মি প্রশস্ত টানা বারান্দা আছে। ভেতরের দিকের উন্মুক্ত চত্বরের সাথে প্রতিটি বাহু সিঁড়ি দিয়ে যুক্ত।
বিহারের উত্তর বাহুর মাঝ বরাবর রয়েছে প্রধান ফটক। এর বাইরের ও ভেতরের দিকে একটি করে স্তম্ভ সংবলিত হলঘর এবং পাশে ছোট ছোট কুঠুরি আছে। এই কুঠুরিগুলো বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হত। প্রধান ফটক এবং বিহারের উত্তর-পূর্ব কোনের মাঝামাঝি অবস্থানে আরও একটি ছোট প্রবেশ পথ ছিলো। এখান থেকে ভেতরের উন্মুক্ত চত্বরে প্রবেশের জন্য যে সিঁড়ি ব্যবহৃত হত তা আজও বিদ্যমান। উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম বাহুতেও অনুরুপ সিঁড়ির ব্যবস্থা ছিলো। এদের মাঝে কেবল পশ্চিম বাহুর সিঁড়ির চিহ্ন আছে। উত্তর বাহুর প্রবেশ পথের সামনে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত একটি পুকুর ছিল। ১৯৮৪-৮৫ সালের খননে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রথম নির্মাণ যুগের পরবর্তী আমলে এ পুকুর খনন করা হয় এবং এসময় এ অংশের সিঁড়িটি ধ্বংস করে দেয়া হয়। পরবর্তীকালে পুকুরটি ভরাট করে দেয়া হয়।

কেন্দ্রীয় মন্দির

বিহারের অন্তর্বর্তী স্থানের উন্মুক্ত চত্বরের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে কেন্দ্রীয় মন্দিরের ধ্বংশাবশেষ। এখন এটি ২১মি উঁচু হলেও মূল মন্দিরটি কমপক্ষে ৩০ মি উঁচু ছিল। তিনটি ক্রমহ্রাসমান ধাপে ঊর্ধ্বগামী এ মন্দিরের ভূমি-পরিকল্পনা ক্রুশাকার। প্রতিটি ক্রুশবাহুর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ১০৮.৩ মি ও ৯৫.৪৫মি। কুশের মধ্যবর্তী স্থানে আরও কয়েকটি অতিরিক্ত দেয়াল কৌণিকভাবে যুক্ত। মূল পরিকল্পনাটির কেন্দ্রে দরজা-জানালা বিহীন একটি শূন্যগর্ভ চতুষ্কোণাকার প্রকোষ্ঠ আছে। এই প্রকোষ্ঠটি মন্দিরের তলদেশ থেকে চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। মূলতঃ এ শূন্যগর্ভ প্রকোষ্ঠটিকে কেন্দ্র করেই সুবিশাল এ মন্দিরের কাঠামো নির্মিত। এ কক্ষের চারদিকে মন্দিরের দ্বিতীয় ধাপে চারটি কক্ষ ও মন্ডপ নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলেই মন্দিরটি ক্রুশাকার ধারণ করেছে। মন্দির পরিকল্পনার সমান্তরালে দেয়াল পরিবেষ্টিত প্রদক্ষিণ পথ আছে। অনুরুপভাবে প্রথম ধাপে দ্বিতীয় ধাপের প্রদক্ষিণ পথের দেয়ালের চারদিকে চারটি কক্ষ যুক্ত করে ক্রুশাকৃতি বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে এবং এর সমান্তরালে প্রদক্ষিণ পথ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রথম ধাপের সমান্তরালে মন্দিরের ভিত্তিভূমির পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে দেয়াল তৈরি করা হয়েছে। উত্তর দিকের মধ্যবর্তীস্থলে সিঁড়ি ছিল। পরবর্তিতে এ সিঁড়ি ধ্বংস করে তার উপর কিছু নতুন কাঠামো নির্মাণ করা হয়।
কেন্দ্রীয় শূন্যগর্ভ কক্ষে একটি ইঁট বাধানো মেঝে আবিষ্কৃত হয়েছে। এ মেঝে কক্ষের বাইরে চারদিকের কক্ষ ও মন্ডপের প্রায় একই সমতলে অবস্তথিত। কিন্তু চারদিকের কক্ষগুলো থেকে কেন্দ্রীয় এ কক্ষে যাওয়ার কোন পথ বা দরজা নেই এবং আগে ছিলো,পরে বন্ধ করা হয়েছে এমন কোন প্রমাণও পাওয়া যায় না। কক্ষে মূর্তি রাখার বেদী বা কুলুঙ্গী কিছুই নেই। তাই অনুমিত হয় ফাঁপা এ দন্ডটি মন্দিরের সুউচ্চ দেয়ালগুলোর সুদৃঢ় নির্মানের জন্য একটি উপকরণ ছিল। মূর্তিগুলো সম্ভবত এর চারদিকের কক্ষগুলোতে স্থাপন করা হয়েছিলো। মন্দিরের শীর্ষদেশের কোন নিদর্শন নেই বিধায় এর ছাদ সম্বন্ধে সুস্পষ্ট কিছু বলা যায় না।
কেন্দ্রীয় শূন্যগর্ভ কক্ষটির দেয়াল নিরাভরণ কিন্তু প্রতিটি ধাপের দেয়ালগুলোর বহির্ভাগ উদগত কার্নিশ, অলংকৃত ইঁট এবং সারিবদ্ধ পোড়ামাটির ফলকচিত্র দ্বারা সজ্জিত। ক্রুশাকার পরিকল্পনার বর্ধিত অংশগুলোর সংযোগস্থলে কার্নিশের প্রান্ত পর্যন্ত পানি নিষ্কাশন নালার ব্যবস্থা আছে। পাথর নির্মিত এ নালাগুলোর মুখ গর্জনরত সিংহের মুখের অবয়বে নির্মিত। ভিত্তিভূমির দেয়ালের বহির্দেশে ৬৩টি কুলুঙ্গি আছে। এর প্রতিটিতে একটি করে পাথরের ভাস্কর্য ছিলো।

উন্মুক্ত অঙ্গন

বিহারের মধ্যবর্তী উন্মুক্ত অঙ্গনে আরও কিছু ইমারতের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এদের মাঝে বেশ কিছু ইমারতের বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। অঙ্গনের দক্ষিণ-পূর্বাংশে ভোজনশালা ও রন্ধনশালা অবস্থিত। এ দুটি স্থাপনার মাঝে ৪৬মি দীর্ঘ ইট বাঁধানো একটি নর্দমা আছে এবং এর কাছে এক সারিতে তিনটি কূপ আছে। এছাড়াও রয়েছে কিছু নিবেদন স্তূপ, প্রশাসনিক ভবন, কেন্দ্রীয় মন্দিরের প্রতিকৃতি ইত্যাদি। নিবেদন স্তূপগুলোর মাঝে দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত স্তূপটি ১৬কোণ বিশিষ্ট নক্ষত্র আকৃতির। অনুচ্চ একটি মঞ্চের মাঝে সংস্থাপিত এ স্তূপটির সংলগ্ন স্থানে রয়েছে একটি পাকা কূপ। অন্যান্য নিবেদন স্তূপগুলো বিক্ষিপ্তভাবে নির্মিত। চত্বরের উত্তর-পূর্বাংশের ইমারতগুলো সম্ভবত প্রশাসনিক এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হত।

স্নানাগার ও শৌচাগার

এটি মূলত বিহারের বাইরের অবস্থিত স্থাপনা। বিহারের দক্ষিণ দেয়াল হতে ২৭মি দক্ষিণে অবস্থিত একটি মঞ্চে অনেকগুলো স্নানাগার ও শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছিলো। মঞ্চটি পূর্ব-পশ্চিমে ৩২মি দীর্ঘ ও উত্তর-দক্ষিণে ৮.২৩মি প্রশস্ত। এটি বিহারের ১০২ নম্বর কক্ষ থেকে একটি উঁচু বাধানো পথ দ্বারা সংযুক্ত। এই পথের নিচে বিহার দেয়ালের সমান্তরালে ১.৯২মি চওড়া এবং ২.৫মি উঁচু একটি ভল্টযুক্ত খিলান রয়েছে। সম্ভবত বিহারের বহির্ভাগে অবাধে চলাচল এবং চারদিকে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করার জন্য এইরুপ করা হয়েছিলো।

সংলগ্ন কীর্তিরাজি

স্নানঘাট

বিহারের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে প্রায় ৪৯মি দক্ষিণে প্রায় ৩.৫মি প্রশস্ত স্নানঘাট অবস্থিত। এর দুপাশে প্রতিটি দেয়াল ১.৫মি প্রশস্ত। খাড়াভাবে ইট স্থাপিত করে এ ঘাটটি নির্মাণ করা হয়েছিলো আর এর সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ধাপে বিরাটকার পাথর ছিল। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ঘাটটি ঢালু হয়ে প্রায় ১২মি নিচে নেমে গিয়েছে। ঘাটের উপর পুরু বালির স্তর ছিল। এ থেকে অনুমান করা হয়, এ ঘাট জলাশয় বিশেষতঃ নদীর সাথে সম্পৃক্ত ছিল।

গন্ধেশ্বরী মন্দির

স্নানঘাট থেকে ১২ মি পশ্চিমে পূর্বমুখী একটি ইমারত পাওয়া গেছে যাকে স্থানীয় ভাবে বলা হয় গন্ধেশ্বরীর মন্দির।এর দৈর্ঘ্য ৬.৭মি ও প্রস্থ ৩.৫মি। এর সম্মুখ দেয়ালের ইটে পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মসহ বিভিন্ন ধরনের ফুলের নকশা এবং গাঁথুনিতে ব্যবহৃত উপাদান দেখে মনে হয় এদেশে মুসলমান যুগের প্রথম এ ইমারতটি নির্মিত হয়েছিলো। এতে একটি চতুষ্কোণ হলঘর রয়েছে। হলঘরের মধ্যবর্তী স্থানে অষ্টকোণাকৃতি একটি স্তম্ভের নিম্নাংশ পাওয়া যায়। পশ্চিমের উদগত একটি দেয়ালের বাইরের দিকে ১.৪মি বাহু বিশিষ্ট বর্গাকার একটি পূজার কক্ষ রয়েছে। তাছাড়া হলঘরের চারটি কুলুঙ্গিতেও মূর্তি স্থাপনের ব্যবস্থা আছে।মন্দিরের সামনে একটি চত্বর আছে। এর মেঝে খাড়া ভাবে স্থাপিত ইট দিয়ে গাঁথা এবং গাঁথুনি পাহাড়পুরের অন্যান্য স্থাপত্য-নিদর্শন থেকে পৃথক।

পাহাড়পুর সংলগ্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত উল্লেখযোগ্য মূর্তি

  • বেলে পাথরের চামুন্ডা মূর্তি
  • লাল পাথরের দন্ডায়মান শীতলা মূর্তি
  • কৃষ্ণ পাথরের বিষ্ণুর খন্ডাংশ
  • কৃষ্ণ পাথরের দন্ডায়মান গণেশ
  • বেলে পাথরের কীর্তি মূর্তি
  • দুবলহাটির মহারাণীর তৈলচিত্র
  • হরগৌরীর ক্ষতিগ্রস্থ মূর্তি
  • কৃষ্ণ পাথরের লক্ষ্ণী নারায়নের ভগ্ন মূর্তি
  • কৃষ্ণ পাথরের উমা মূর্তি
  • বেলে পাথরের গৌরী মূর্তি
  • বেলে পাথরের বিষ্ণু মূর্তি
  • নন্দী মূর্তি
  • কৃষ্ণ পাথরের বিষ্ণু মূর্তি
  • সূর্য মূর্তি
  • কৃষ্ণ পাথরের শিবলিঙ্গ
  • বেলে পাথরের মনসা মূর্তি

গ্যালারি

Paharpur Terracotta by Farhana 2.jpgPaharpur Terracotta by Farhana 1.jpgPaharpur 03.JPGCentral Sherine deccor-Paharpur.jpg
Gate of Pahadpur.jpgPaharpur Terracotta by Farhana 4.jpgPaharpur Terracotta by Farhana 3.jpg

Wednesday, June 15, 2016

ইলেকট্রন


ইলেকট্রন

ইলেকট্রন
পরমাণুর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় কক্ষে এস, পি ও ডি অরবাইটালের ইলেক্ট্রন-ঘনত্ব বিন্যাসের তাত্বিক পরিমাপ রং দিয়ে দেখানো হয়েছেঃ কালো মানে ঘনত্ব শূন্য, সাদা মানে সর্বোচ্চ ঘনত্ব, লালের মধ্যে কালচে বা সাদাটে ভাবের তারতম্যে বিভিন্ন মাঝারি ঘনত্ব দেখানো হয়েছে
গঠনমৌলিকা কণিকা
পরিসংখ্যানফার্মিয়ন
প্রজন্মপ্রথম
মিথষ্ক্রিয়াঅভিকর্ষ, তাড়িতচৌম্বক মিথস্ক্রিয়া, দুর্বল মিথস্ক্রিয়া
প্রতীকe-, β-
প্রতিকণাপজিট্রন
তত্ত্বজি. জনস্টোন স্টোনি (১৮৭৪)
আবিষ্কারজে. জে. টমসন (১৮৯৭)
ভর৯.১০৯ ৩৮২৬ (১৬) × ১০–৩১ কেজি
৫.৪৮৫ ৭৯৯ ০৯৪৫(২৪) × ১০–৪ এএমইউ
১৮২২.৮৮৮ ৪৮৪৯(৮) এএমইউ
০.৫১০ ৯৯৮ ৯১৮(৪৪) MeV/c
ইলেকট্রিক চার্জ–১.৬০২ ১৭৬ ৫৩(১৪) × 10-১৯ C
Spin½
ইলেকট্রন একটি অধঃ-পরমাণু (subatomic) মৌলিক কণা (elementary particle) যা একটি ঋণাত্মক তড়িৎ আধান বহন করে। ইলেকট্রন একটি স্পিন -১/২ অর্থাৎ ফার্মিয়ন) এবং লেপ্টন শ্রেনীভুক্ত। এটি প্রধানত তড়িৎ-চুম্বকীয় মিথষ্ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। পারমাণবিক কেন্দ্রীনের (নিউক্লিয়াসের) সঙ্গে একত্র হয়ে ইলেকট্রন পরমাণু তৈরি করে এবং এর রাসায়নিক বন্ধনে অংশগ্রহণ করে। মূলত ইলেকট্রন চলাচলের দরুন কঠিন পরিবাহীতে বিদ্যুতের প্রবাহ ঘটে। ইলেক্ট্রনের স্পিন ও ইলেক্ট্রন প্রবাহের বর্তুলতা (চক্রাকার প্রবাহ) বা ত্বরণের জন্য চৌম্বকত্ব তৈরি হয়।

আবিষ্কারের ইতিহাস

প্রাথমিক পর্যায়

HAtomOrbitals.pngবিজ্ঞানী জি. জনস্টোন স্টোনি সর্বপ্রথম তড়িৎ রসায়নে ইলেকট্রনকে আধানের একটি একক হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং তিনিই ১৮৯১ সালে ইলেকট্রন নামকরণ করেন। ১৮৯০-এর দশকে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী বলেন যে তড়িৎ বিচ্ছিন্ন একেকের দ্বারা গঠিত হতে পারে এবং এভাবেই এ বিষয়ে সবচেয়ে ভাল ধারণা করা সম্ভব। এই এককগুলোর অনেক নামই প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু তখনও পর্যন্ত বাস্তব ভিত্তিতে এর প্রমাণ দেয়া সম্ভব হয়নি।

টমসনের পরীক্ষা

ইলেকট্রন যে একটি উপআনবিক কণিকা তা সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী জে. জে. টমসন ১৮৯৭ সালে আবিষ্কার করেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেন্ডিশ গবেষণাগারে ক্যাথোড রশ্মি নল নিয়ে গবেষণা করার সময় তিনি এই আবিষ্কার করেন। ক্যাথোড রশ্মি নল হল একটি সম্পূর্ণ বদ্ধ কাচের সিলিন্ডার যার মধ্যে দুইটি তড়িৎ ধারক (electrode) শূণ্য স্থান দ্বারা পৃথ করা থাকে। যখন দুইটি তড়িৎ ধারকের মধ্যে বিভব পার্থক্য প্রয়োগ করা হয় তখন ক্যাথোড রশ্মি উৎপন্ন হয় এবং এর ফলে নলের মধ্যে আভার সৃষ্টি হয়। উপর্যুপরী পরীক্ষার মাধ্যমে টমসন প্রমাণ করেন যে চৌম্বকত্বের সাহায্যে রশ্মি থেকে ঋণাত্মক আধান পৃথক করা যায় না; তবে তড়িৎ ক্ষেত্র দ্বারা রশ্মিগুলোকে বিক্ষিপ্ত করা যায়। মূলত ইলেকট্রনের আবিষ্কার এবং এর অংশসমূহ সম্বন্ধে ধারণা লাভ করতে গিয়ে টমসনকে তিন তিনটি পরীক্ষা সম্পাদন করতে হয়েছিলো:
প্রথমত:
এই পরীক্ষার সাথে ১৮৯৫ সালে জ্যাঁ পেরিন কৃত পরীক্ষার বেশ মিল ছিল। টমসন এক জোড়া ধাতুর সিলিন্ডার দ্বারা একটি ক্যাথোড রশ্মি নল তৈরি করেন যার মধ্যে একটি সংকীর্ণ ফাঁক ছিল। এই সিলিন্ডারদ্বয় আবার একটি ইলেকট্রোমিটারের সাথে সংযুক্ত ছিল যাতে তড়িৎ আধান সংরক্ষণ এবং পরিমাপ করা যায়। পেরিন দেখেছিলেন ক্যাথোড রশ্মি একটি তড়িৎ আধান জমা করে। টমসন দেখতে চেয়েছিলেন একটি চুম্বকের মাধ্যমে রশ্মিগুলো বাঁকিয়ে রশ্মি থেকে আধান পৃথক করা যায় কি-না। তিনি দেখতে পান রশ্মিগুলো যখন সিলিন্ডারের সরু ফাঁকে প্রবেশ করে তখন ইলেকট্রোমিটারে ঋণাত্মক আধানের আধিক্য দেখা যায়। রশ্মিগুলো বাঁকিয়ে দিলে মিটারে ঋণাত্মক আধানের পরিমাণ এতো হয়না, কারণ রশ্মি তখন ফাঁকে প্রবেশেরই সুযোগ পায় না। এ থেকে স্পষ্টতই ধারণা করে নেয়া যায় যে ক্যাথোড রশ্মি এবং ঋণাত্মক আধান যেভাবেই হোক একসাথে থাকে, এদের পৃথক করা যায় না।
দ্বিতীয়ত:
পদার্থবিজ্ঞানীরা তড়িৎ ক্ষেত্রের সাহায্যে ক্যাথোড রশ্মি বাঁকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এবার টমসন একটি নতুন পরীক্ষণের কথা চিন্তা করেন। একটি আয়নিত কণা তড়িৎ ক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হলে অবশ্যই বেঁকে যাবে, কিন্তু যদি একে যদি একটি পরিবাহী দ্বারা ঘিরে দেয়া হয় তবে আর বাঁকবে না। তিনি সন্দেহ করেন যে নলের মধ্যে বিরাজমান গ্যাস বিশেষ পরিস্থিতিতে ক্যাথোড রশ্মির কারণেই তড়িৎ পরিবাহীতে পরিণত হয়েছে। এই ধারণা প্রমাণ করার জন্য অনেক কষ্টে তিনি একটি নলকে প্রায় বিশুদ্ধ শূণ্যস্থান করতে সমর্থ হন। এবার পরীক্ষা চালিয়ে দেখা যায় ক্যাথোড রশ্মি তড়িঃ ক্ষেত্র দ্বারা বেঁকে যাচ্ছে। এই দুইটি পরীক্ষণ থেকে টমসন সিদ্ধান্তে পৌঁছান,
আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছা থেকে কোন ভাবেই পালাতে পারিনা যে ক্যাথোড রশ্মি হল ঋণাত্মক তড়িতের আধান যা পদার্থের কণিকা দ্বারা বাহিত হয়।.... এই কণিকাগুলো কি? এরা কি পরমাণু, অথবা অণু, অথবা এমন পদার্থ যা এখন পর্যন্ত উপবিভাগের একটি সূক্ষ্মতম পর্যায়ে রয়েছে?
তৃতীয়ত:
টমসনের তৃতীয় পরীক্ষার বিষয়বস্তু ছিল কণিকাসমূহের মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ অনুসন্ধান করা। তিনি যদিও এ ধরণের কোন কণিকার সরাসরি ভর বা আধান বরে করতে পারেন নি, তবে চুম্বকত্বের দ্বারা এই রশ্মিগুলো কতটা বাঁকে এবং এদের মধ্যে কি পরিমাণ শক্তি রয়েছে তা পরিমাপ করতে পেরেছিলেন। এই উপাত্তগুলোর মাধ্যমে তিনি একটি কণিকার ভর এবং এর তড়িৎ আধানের মধ্যে একটি অনুপাত বের করেন। নিশ্চয়তার জন্য তিনি অনেক ধরণের নল এবং গ্যাস নিয়ে পরীক্ষণ সম্পাদন করার মাধ্যমে উপাত্তগুলো সংগ্রহ করেন। এই অনুপাত থেকে বেশ আশ্চর্যজনক ফল পাওয়া যায়; এর মান একটি আয়নিত হাইড্রোজেনের তুলনায় এক হাজার গুণেরও বেশি ছোট হয়।

পরবর্তী যুগ

অনুপাতের পরিমাণটি এতো ছোট হওয়ার বিষয়টি পরীক্ষণের পর এমিল ওয়াইখার্ট (Emil Wiechert) উত্থাপন করেন। এ হিসেবে, হয় ক্যাথোড রশ্মির আধানের পরিমাণ বিপুল (আয়নিক পরমাণূর তুলনায়) অথবা তারা তাদের আধানের তুলনায় আশ্চর্যজনকভাবেই হালকা। এই দুটি সম্ভাবনার মধ্যে বেছে নেয়ার বিষয়টি ফিলিপ লিনার্ড নির্দিষ্ট করেন। ক্যাথোড রশ্মি কিভাবে গ্যাসের বাঁধা অতিক্রম করে তা নিয়ে পরীক্ষা করে তিনি দেখান যে, ক্যাথোড রশ্মি যদি কণিকা হয় তবে তার ভর অতি ক্ষুদ্র হতে হবে, যেকোন পরমাণুর চেয়েও অনেক ক্ষুদ্র। অবশ্য এর সুনির্দিষ্ট প্রমাণ তখনও দেয়া সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে গবেষণায় নির্দিষ্ট মান বেরিয়ে এসেছে। যেমন ১৯০৯ সালে রবার্ট মিলিকান তার তৈল-বিন্দু পরীক্ষার সাহায্যে ইলেকট্রনের আধান নির্ণয় করেন। টমসন দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে,
ক্যাথোড রশ্মির মধ্যে আমরা পদার্থের একটি নতুন অবস্থার সন্ধান পাই, এটি এমন এক অবস্থা যাতে পদার্থের উপবিভক্ত অংশগুলোও সাধারণ গ্যাসীয় অবস্থার তুলনায় অনেক বেশি বাহিত হয়: এমন এক অবস্থা যাতে সকল পদার্থ একটি এবং একই শ্রেণীর; এই পদার্থটিই সেই সারবস্তু যা থেকে সকল রাসায়নিক মৌলসমূহ সৃষ্টি হয়েছে।
পর্যায়বৃত্ত ধর্ম অনুসারে মৌলসমূহের রাসায়নিক ধর্ম পর্যায়বৃত্তভাবে ব্যাপকহারে পরিবর্তীত হয়্এবং এটিই বর্তমান পর্যায় সারণীর ভিত্তি রচনা করেছে। এই তত্ত্বটিকে আদিতে পারমানবিক ভর দ্বারা ব্যাখ্যা করা হতো, কিন্তু পারমানবিক ভরের ক্রম ঠিক না থাকায় এ নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়। ১৯১৩ সালে বিজ্ঞানী অঁরি মোসলে পারমানবিক সংখ্যার ধারণা প্রবর্তন করেন এবং প্রতিটি পরমাণুর মধ্যস্থিত প্রোটন সংখ্যা দ্বারা পর্যায়বৃত্ত ধর্ম ব্যাখ্যা করেন। এতই বছর নিল্‌স বোর দেখান যে ইলেকট্রনই প্রকৃতপক্ষে পর্যায় সারণীর মূল ভিত্তি। ১৯১৬ সালে গালবার্ট নিউটন লুইস ইলেকট্রনীয় মিখস্ক্রীয়ার মাধ্যমে রাসায়নিক বন্ধন ব্যাখ্য করেন।

শ্রেণীবিভাগ

ইলেকট্রন লেপ্টন নামক অধঃপারমানবিক কণার শেণীতে অবস্থিত। এদেরকে মৌল কণিকা হিসেবে ধরা হয়, অর্থাৎ এদেরকে আরও ক্ষুদ্রতর অংশে ভাগ করা সম্ভব নয়। অন্যান্য কণার মত ইলেকট্রনও তরঙ্গ হিসেবে আচরণ করতে পারে। এই আচরণটিকে তরঙ্গ-কণা দ্বৈত আচরণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পদার্থবিজ্ঞানে এর অপর নাম কমপ্লিমেন্টারিটি, এই নামটি বিজ্ঞানী নিল্‌স বোর কর্তৃক প্রদত্ত। দ্বি-চির পরীক্ষা দ্বারা এটি প্রমাণ করা যায়।
ইলেকট্রনের প্রতিকণিকার নাম পজিট্রন। বোঝাই যাচ্ছে যে পজিট্রনের ভর হুবহু ইলেকট্রনের সমান কিন্তু আধান ধনাত্মক হওয়ার পরিবর্তে ঋণাত্মক, যদিও আধানের মান সমান। পজিট্রনের আবিষ্কারক কার্ল ডেভিড এন্ডারসন আদর্শ ইলেকট্রনকে নেগেট্রন নামে ডাকার প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইলেকট্রন নামটি একটি সাধারণ শব্দ হিসেবে ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক উভয় আধান বোঝাতে ব্যবহার করা উচিত। তবে এই প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় নি।

বৈশিষ্ট্য ও আচরণ

প্রতিটি ইলেকট্রন একটি ঋণাত্মক তড়িৎ আধান বহন করে। এটি তড়িৎ-চুম্বকীয় মিথষ্ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। পারমাণবিক কেন্দ্রীনের (নিউক্লিয়াসের) সঙ্গে একত্র হয়ে ইলেকট্রন পরমাণু তৈরি করে এবং এর রাসায়নিক বন্ধনে অংশগ্রহণ করে। মূলত ইলেকট্রন চলাচলের ফলেই কঠিন পরিবাহীতে বিদ্যুতের প্রবাহ ঘটে। ইলেক্ট্রনের স্পিন ও ইলেক্ট্রন প্রবাহের বর্তুলতা (চক্রাকার প্রবাহ) বা ত্বরণের জন্য চৌম্বকত্ব তৈরি হয়। uf8iaieiifjodvfpofhopgigerpafhih9 fhop9foipfpoi9ejsoofpnefoioo b fe

ইলেকট্রনের ব্যবহার

দৈনন্দিন ঘটনায় গুরুত্ব

যদিও পদার্থবিদ্যায় তড়িৎ আধানের মধ্যে আকর্ষণ-বিকর্ষণ (স্থির তড়িৎ), বিদ্যুৎ ও চৌম্বক ক্রিয়া কেবল এই দুই-তিন রকম ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনের ভূমিকার কথাই বেশি বলা হয়, ভরজনিত জাড্যতা ছাড়া আমাদের চারিপাশের দৃশ্য বিশ্বের পদার্থের অন্যান্য অধিকাংশ ভৌত ধর্ম (ও অবশ্যই সমস্ত রাসায়নিক ধর্ম) পদার্থটির মধ্যের ইলেক্ট্রনগুলির বন্ধন ও বিন্যাসের উপর নির্ভর করে -- যেমন হীরাকাঠিন্য সমযোজী বন্ধন সমূহের বিস্তারিত জালের জন্য; বিভিন্ন রঙ্গক পদার্থের রঙ তাদের উচ্চতম শক্তির আলগা ইলেক্ট্রনগুলি কোন কম্পাঙ্কের ফোটন শোষণ করে তার উপর; গঁদের আঠার আঠালোভাব তার ভ্যান ডার ওয়ালস বন্ধন ক্ষমতার জন্য; বুলেটপ্রুফ জামার দুর্ভেদ্যতা ও বোরোজেন (বোরন নাইট্রাইড) এর কাঠিন্য আসে ছড়িয়া থাকা (ডিলোকালাইজড) বা ইলেক্ট্রন-ডেফিসিয়েন্ট বন্ধনের জন্য; শ্লেষ্মার পিচ্ছিল ভাবতরুণাস্থি ইত্যাদি হাইড্রোজেল-এর চাপ সহ্য করার ক্ষমতা এদের মধ্যে স্বল্প-ব্যবধানে অবস্থিত অনেক ঋণাত্মক আধানের বিকর্ষণের জন্য; ধাতুর স্প্রিং-এর দৃঢ়তাইলাস্টিসিটি, ধাতুকে পিটিয়ে কতটা পাতলা পাত বানানো যায় (ম্যালিয়েবিলিটি), তার টেনে কতটা লম্বা করা যায় (ডাক্টিলিটি), নমনীয়তা ইত্যাদি ধাতব ইলেক্ট্রনীয় বন্ধনের কিছু ধর্মের জন্য; এবং বিভিন্ন জৈব পদার্থের জল বা তেলে দ্রাব্যতা তাদের মধ্যেকার বন্ধন-গুলি পোলার না নন-পোলার তার উপর নির্ভর করে; বিভিন্ন তেলের গলনাঙ্কস্ফুটনাঙ্ক তাদের ফ্যাটি অ্যাসিডের কার্বন শৃঙ্খলের মধ্যে দ্বিবন্ধনের সংখ্যার উপর নির্ভর করে।

Wednesday, June 1, 2016